আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখতে গিয়েই চরম ভুল করেছিলেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। দেশের মুদি ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় বেছে নিয়েছিলেন রাশিয়ার পথ—শপিং মলের নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির প্রলোভনে দালাল ধরে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর মস্কোয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য হন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঠেলে দেওয়া হয় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে।
দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে গতকাল বুধ (৮ অক্টোবর) বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয় পরিবারকে।
নজরুল ইসলাম রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে। তাঁর বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম ফকির ভাইয়ের মর্মান্তিক পরিণতির কথা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন। রহিম বলেন, নজরুল সেনাবাহিনীতে ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান। অবসরের পর মুদি ব্যবসা শুরু করলেও তাতে লোকসান হওয়ায় পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে। এই সংকটের মধ্যে স্থানীয় দালাল ফরিদ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। ফরিদ তাঁকে রাশিয়ায় শপিং মলে নিরাপত্তাকর্মীর ভালো চাকরির প্রলোভন দেখায়। সেই স্বপ্ন নিয়ে ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন নজরুল।
রহিম ফকির অভিযোগ করেন, সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁর ভাই এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য হন এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা অবস্থায়ও তিনি নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে কথা বলতেন।
নজরুল তাঁর স্ত্রী আইরিন আক্তারকে মাঝে মধ্যে বলতেন সেই ভয়ানক কথাগুলো: ‘এখান থেকে ফিরে আসার আমার কোনো পথ নেই। কখনো আমার ফোন বন্ধ পেলে ধরে নিবা আমি মারা গেছি।’
পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় গত ৩০ এপ্রিল। সেই দিন নজরুল স্ত্রীকে বলেছিলেন টাকা পাঠাতে ব্যাংকে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরই ফোনকল করে দ্রুত চলে যাওয়ার কথা বলে জানান, টাকা পাঠানো হলো না। এরপর থেকেই তাঁর ফোন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আইরিন আক্তার শোক সামলাতে পারছেন না। চার মেয়েকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে এখন শুধু স্বামীর লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে মিনতি করছেন তিনি।
আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী অবসরের পর বাড়িতে থাকত। ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ফরিদ দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় যায়। আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম সন্তানদের নিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকব। কিন্তু সে বলল রাশিয়ায় ভালো চাকরি আছে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ। এখন আমি চার মেয়েকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব?’
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তার একটাই আর্তি: ‘আমার স্বামীর লাশ অন্তত আমার কাছে এনে দিক সরকার। শেষবার আমি একটু আমার স্বামীকে দেখতে চাই।’